সম্প্রতি করোনা মহামারী নিয়ে পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যম
বিশ্বব্যাপী প্রচার চালাচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে। তাদের পরিস্কার বক্তব্য, চীন করোনা সংক্রান্ত
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি চেপে দিয়ে, বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাস ছড়াতে সাহায্য করেছে। যার
ফলে বিশ্বের প্রায় তেরো লক্ষের বেশি মানুষ আজ অব্দি করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত। শেষ খবর
পাওয়া অব্দি চুয়াত্তর হাজার সাতশ বিরাশি জনের মৃত্যু হয়ে গিয়েছে। এবং সংকটজনক অবস্থায়
মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন সাতচল্লিশ হাজার তিনশ ছিয়ানব্বই জন। পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যম
এই গোটা ঘটনার দায় চীনের উপর চাপিয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষকে চীনের বিরুদ্ধে সংঘটিত
করার এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক
আদালতের মাধ্যমে চীনের কাছ থেকে ৬.৫ ট্রিলিয়ন ক্ষতিপূরণ আদায় করার কথাও।
বিস্তারিত এই লিংকে:
বিস্তারিত এই লিংকে:
পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যমের এই ভুমিকা নতুন কিছু নয়।
বস্তুত ইঙ্গমার্কিণ স্বার্থসুরক্ষার কারণে তারা বিভিন্ন সময়েই নানান ভাবে এই ভুমিকাই
পালন করে থাকে। বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করে ইঙ্গমার্কিণ স্বার্থসুরক্ষিত করাই পাশ্চাত্য
সংবাদ মাধ্যমের প্রধান কাজ। এর আগে ওয়ার্ল্ড ট্রেডসেন্টার ধ্বংসের সময়েও ঠিক এই ভাবেই
বিশ্বজনমতকে আফগানিস্তান ও ইরাকের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা হয়েছিল। সম্পূর্ণ মিথ্যা অপপ্রচার
চালিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল ইরাক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরী করছে। সাদ্দাম হোসেনের
বিরুদ্ধে জৈব অস্ত্র তৈরীর মিথ্যা প্রচার চালানও হয়েছিল অত্যন্ত সফল ভাবে। এবং এই মিথ্যা
অপপ্রচারের মুল্য দিতে হয়েছে কোটি কোটি সাধারণ ইরাকী ও আফগান মানুষকেই। বিশ্ববিবেকের
তাতে কিছু এসে যায় নি। না, পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যমের অপ্রপ্রচারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা
করার উদ্দেশ্য আমাদের নয়। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের এই দুঃসময়ে চীনের হয়ে ওকালতি
করাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। চীনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চীন কি করে মোকাবিলা করবে সে বিষয়ে
আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহও নাই। আমাদের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যমের
অভিযোগকে মাথায় রেখে এই পর্বে অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের চীন থেকে বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের
একেবারে প্রাথমিক পর্বে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভুমিকা কি ছিল সেটিই দেখা।
এই বিষয়ে আমরা নির্ভর করবো রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রকাশিত
তথ্যের উপরেই। অন্য কোন সংবাদ সূত্রের উপরে নয়। চীন বিশ্বকে কখন কি তথ্য ঠিকমত সরবরাহ
করেছে কি করে নি, সেই বিষয়ে আমাদের আগ্রহ নাই। আমাদের আগ্রহ রাষ্ট্রপুঞ্জ বিশ্বের অন্যান্য
দেশের সামনে কখন কোন কোন তথ্য হাজির করে ঠিক কতটা সাবধান বাণী প্রচারিত করেছে সেই বিষয়ে।
কারণ, বিশ্বের বাকি দেশগুলির রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রচারিত তথ্যের উপর নির্ভর করেই সরকারী
পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়ন করার কথা। ফলে সেখানে চীনের সরবরাহকৃত তথ্যের ভুমিকা গৌণ।
মুখ্য ভুমিকা রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিদিনের নির্দেশিকাগুলিই।
এবার একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক করোনা
সংক্রান্ত একেবারে প্রাথমিক ঘটনা প্রবাহের দিকে। ২০১৯এর একেবারে শেষদিন ৩১শে
ডিসেম্বর বিশ্বস্বাস্থ সংস্থা হু’র চীনের
শাখায় প্রথম নিমুনিয়া সংক্রান্ত ঘটনার কথা জানানো হয়। সেই দিন থেকে জানুয়ারীর ৩
তারিখ অব্দি চীনে মোট ৪৪জনের সংক্রমণের খবর পায় বিশ্বস্বাস্থ সংস্থা হু। জানুয়ারীর
সাত তারিখে চীন প্রথম নতুন ধরণের এই করোনা ভাইরাসের হদিশ পায়। এবং এই মাসেরই ১২ই
জানুয়ারী চীন এই নতুন ধরণের করোনা ভাইরাসের জেনেটিক তথ্য বিশ্বের কাছে হাজির করে।
যাতে এই নিয়ে গবেষণা শুরু হতে পারে। কিভাবে মোকাবিলা করা যাবে করোনাকে। ১৩ই
জানুয়ারী থাইল্যাণ্ডে এবং ১৫ই জানুয়ারী জাপানে প্রথম করোনা আক্রান্তের হদিশ মেলে।
এবং জানা যায়, এই দুই ক্ষেত্রেই
সংক্রমণ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকেই ছড়িয়েছে। অর্থাৎ উহান থেকে আগত বিমান
যাত্রীর মাধ্যমেই এই দুইদেশে করোনার প্রবেশ ঘটে। এরপরেই দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা
আক্রান্তের হদিশ মেলে। এবং এই সব কয়টি ক্ষেত্রেই সরাসরি চীন থেকে আগত বিমান
যাত্রীর মাধ্যমই অনুঘটকের কাজ করে।
সোমবার ১৩ই জানুয়ারী, বিশ্বস্বাস্থ
সংস্থা জানায় যে চীন ছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকেও তারা নতুন এই রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা
করছে। In its
(Monday 13th Jan’20) statement, WHO noted that it has been expecting cases to
be reported in countries other than China, underscoring the importance of
monitoring and preparedness in other countries.
২১শে জানুয়ারী ২০২০: রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে,
নতুন এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়ানো শুরু করে দিয়েছে। এই দিনেই আমেরিকা
থেকে খবর আসে ওয়াশিংটনে চীনের উহান থেকে ফেরৎ এক বিমানযাত্রী এই রোগের শিকার হয়েছে।
এই দিনই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র তারিক জাসরেভিচ জানিয়ে দেন চীনের বাইরে চার
জনের এই রোগ ধরা পড়েছে। যার ভিতর থাইল্যাণ্ড জাপান ও কোরিয়াও রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থার সদর দপ্তর জেনেভায় দেওয়া এই দিনের প্রেস বিবৃতিতে তিনি জানিয়ে দেন যে তিনি আশঙ্কা করছেন এই রোগ চীনের অন্যান্য
অংশ সহ বিশ্বের নানা প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ জানুয়ারীর ২১ তারিখেই রাষ্ট্রপুঞ্জের
কাছে মোটামুটি পরিস্কার হয়ে যায়, করোনা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে। এবং উহান
থেকে বিমান যাত্রীদের মাধ্যমে এই সংক্রমণ অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। যে রোগ মানুষ
থেকে মানুষে সংক্রমিত হতে থাকে, সেই রোগ জনবহুল দেশ ও অঞ্চলগুলিতে কি মারাত্মক ভাবে
দেখা দিতে পারে, সেটি রাষ্ট্রপুঞ্জের খুব ভালো করেই জানার কথা। ফলে জানুয়ারীর তৃতীয়
সপ্তাহেই এই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়, নতুন এই ভাইরাস সংক্রমণ আর শুধু চীনেই আটকিয়ে
নাই। সেটি বিমানযাত্রীদের মাধ্যমে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই সময় থেকেই সঠিক সাবধানতা
নেওয়া যেত তাহলে আজ হয়তো বিশ্ববাসীকে এই পরিস্থিতির সম্মূখীন হতে হতো না। তথ্যসূত্র:
রাষ্ট্রপুঞ্জের ওয়েবসাইট
২২শে জানুয়ারী ২০২০: রাষ্ট্রপুঞ্জের এই
দিনের প্রচারিত তথ্যে জানা যাচ্ছে, সর্বমোট ৪৪০ জন নতুন এই ভাইরাসে সংক্রমিত। মাত্র
একদিনের ব্যবধানে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে ১৭তে পৌঁছিয়েছে। অর্থাৎ রোগের ভয়াবহতা
ও দ্রুতহারে সংক্রমণের বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই সময়ে ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছে। যে কারণে
এই একই দিনে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অধিকার্তা Tedros Adhanom
Ghebreyesus বলেন, “The decision about whether or not to
declare a public health emergency of international concern is one I take
extremely seriously, and one I am only prepared to make with appropriate
consideration of all the evidence.” তথ্যসূত্র রাষ্ট্রপুঞ্জ
আরও জানানো হয়, অস্ট্রেলিয়া
সিঙ্গাপুর হংকং তাইওয়ান আমেরিকা রাশিয়া ও জাপান সহ বিভিন্ন দেশে বিমানবন্দরে যাত্রীদের
স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থাও শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ জানুয়ারীতেই বেশ কিছু দেশ এটা বুঝে
যায় যে নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণের রাজপথ আন্তর্জাতিক
বিমান পরিসেবাসহ বিমানবন্দরগুলিই। এবং বিমানযাত্রীদের মাধ্যমেই মানুষ থেকে মানুষের
মধ্যে সংক্রমণের বিষয়টি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ফলে একথা বলার উপায় নাই,
যে এইসময় অধিকাংশ দেশ করোনা সংক্রমণের গতিবিধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল বলেই
সময় মতো সুরক্ষার বন্দোবস্ত গ্রহণ করতে পারেনি।
২৩শে জানুয়ারী ২০২০: বৃহস্পতিবার জেনেভার
সদর দপ্তরে এক প্রেস কন্ফারেন্সে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অধিকর্তা জানিয়ে দিলেন, “We have
provided guidance to all countries for the rapid identification, management and
containment of the virus based on the sequence we've got from China. We're
coordinating our networks of global experts. We're working to advance the
development of diagnostics, therapeutics, and vaccines. We are completely
committed”. তথ্যসূত্র: রাষ্ট্রপুঞ্জ।
তিনি এও জানান চীন ও বিশ্বব্যাপী
পরিস্থিতি ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রুগীদের
প্রায় এক চতুর্থ শতাংশের অবস্থাই সঙ্কটজনক। অর্থাৎ করোনার ভয়াবহতার বিষয়টি জানুয়ারীর
তৃতীয় সপ্তাহেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এবং এই বিষয়ের গুরুত্ব রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বের সব কয়টি দেশেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অধিকর্তার বক্তব্যেই জানা যাচ্ছে চীন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই
পরিস্থিতির গুরুত্ব ও ভয়াবহতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। ফলে চীনের বিরুদ্ধে তথ্য
গোপন করে বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচার রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া তথ্যের সাথে
মেলানো সম্ভব হচ্ছে না। লক্ষ্য করে দেখতে হবে জানুয়ারীর ২৩ তারিখের ভিতরেই রাষ্ট্রপুঞ্জের
হাতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতার ছবিটি পরিস্কার
ধরে পড়ে গিয়েছিল। স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সংক্রমণটি আর চীনের মধ্যেই আটকিয়ে নাই। বিশ্বব্যাপী
ছড়িয়ে পড়ছিল।
২৫শে জানুয়ারী: রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া
এইদিনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২৪শে জানুয়ারী ফ্রান্সে চীনের উহান ফেরত ৩ জনের ভিতর করোনা
সংক্রমণ ধরা পড়ে। ইউরোপে করোনা সংক্রমণের এটাই ছিল প্রথম খবর। সেদিনের তথ্যে আরও জানা
যাচ্ছে সেদিন অব্দি মোট সংক্রমিত রুগীর সংখ্যা ১৩০০ এবং মৃত্যু হয় ৪১ জনের। অর্থাৎ
সেই সময় থেকেই বিশ্বব্যাপী সঠিক পদক্ষেপ নিলে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমিয়ে অনেক মানুষের
প্রাণ বাঁচানো যেত। কিন্তু সেটি করতে হলে বিশ্বব্যাপী বিমান পরিসেবা বন্ধ করে দিয়ে
করোনা সংক্রমণ রোধ করার পথে এগোতে হতো। দুর্ভাগ্যের বিষয় রাষ্ট্রপুঞ্জ এই বিষয়ে কোন
পদক্ষেপ গ্রহণই করেনি। কোন দেশকেই এই বিষয়ে দিকনির্দেশ দেয়নি। যদিও এই দিনেই তারা সাবধান
বাণী উচ্চারণ করে সংক্রমণ রুখতে সময়মত ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দিয়েছিল। এবং এও জানিয়েছিল
যে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের প্রকৃতির কারণে কোন দেশই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা
পাবে না। তথ্যসূত্র: রাষ্ট্রপুঞ্জ।
এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা
১৮ই ফেব্রুয়ারী অব্দি তাদের নিয়মিত সিচ্যুয়েশন রিপোর্ট সমানে বলে এসেছে, “WHO
does not recommend any specific health measures for travellers. In case of symptoms
suggestive of respiratory illness either during or after travel, travellers are
encouraged to seek medical attention and share their travel history with their
health care provider” তথ্যসুত্র:
বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থা
অর্থাৎ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে
২৫শে জানুয়ারী ২০২০’র ভিতরেই বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রধান পথটি চিহ্নিত হয়ে
গেলেও, সেই পথে সংক্রমণ ছড়ানো প্রতিহত করার সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রপুঞ্জ সহ প্রতিটি
দেশই উদাসীন ছিল। কোনদেশই বিমান পরিসেবা বন্ধের বিষয়টিকে করোনা মোকবিলায় প্রধান ও সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ পথ বলে মেনে নিতে চায়নি। আর তার ফলেই প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ
সহজ থেকে সহজতর এবং দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়েছিল। পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যম আজ অব্দি সেই
বিষয়ে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ না করে করোনা সংক্রমণে চীনকে দায়ী করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে
উঠে পড়ে লেগেছে বিশ্বব্যাপী প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে।
২৭শে জানুয়ারী: রাষ্ট্রপুঞ্জের এইদিনের
খবরে জানা যাচ্ছে ২৬শে জানুয়ারী বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আধিকর্তা তার সহকর্মীদের নিয়ে
বেজিং-এ অবতরণ করেন চীনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখার জন্য। তাদের মূল
উদ্দেশ্য ছিল মানুষ থেকে মানুষে করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনার বিষয়ে রূপরেখা তৈরী করা এবং
দ্রত সংক্রমিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার বিষয়টি নির্ধারণ করার উপায় বের করা।
২৯শে জানুয়ারী: এইদিন বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থার অধিকর্তা ঘোষণা করেন চীনের বাইরে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মোট ৬৮টি সংক্রমণের
খবর পাওয়া গিয়েছে। সেটি যদিও মোট সংক্রমণের মাত্র এক শতাংশ, কিন্তু সংক্রমণের ভৌগলিক
ব্যাপ্তি অনেক বেশি অঞ্চল জুড়ে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণপূর্ব
এশিয়া। ফলে এটি পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে এসে করোনার বিশ্বের নানা
প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আশা করি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এই ছড়িয়ে পড়া ঠিক কোন
পথে সংঘটিত হয়েছে। এবং সেই বিষয়ে বিশ্বব্যাপী কেউই তখনও সেই পথে সংক্রমণ রুখতে সঠিক
ব্যবস্থাও গ্রহণ করে নি। আর সঠিক ব্যবস্থা ঠিক কি হতে পারতো, সেটি কিন্তু একেবারেই
সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা যায়। এটা ভাবার কোন কারণ নাই, বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা
এই সামান্য বিষয়টি তখনো বুঝতে পারেন নি।
এইদিনই জেনেভার সদর দপ্তরে বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থার জরুরী স্বাস্থ্য পরিসেবা বিভাগের প্রধান মাইকেল রায়ান প্রেস বিবৃতিতে জানান,
“"the whole world needs to be on alert now. The whole world needs to
take action and be ready for any cases that come from the epicentre or other
epicentre that becomes established”. অর্থাৎ তারা সেই
সময়েই এটা বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন যে, করোনা সংক্রমণের এপিসেন্টার চীনের উহানেই আটকিয়ে
থাকবে না। আরও নানান স্থানে নতুন নতুন এপিসেন্টার গড়ে উঠবে। তাদের এই বুঝতে পারা যে
কত সঠিক ছিল সেটি আজ বিশ্ববাসী মাত্রেই দেখতে পারছে। তিনি আরও বলেন, চীন কর্তৃপক্ষ
ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে না পারলেও তার বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার গতিকে কিছুটা হলেও
কমিয়ে দিতে পেরেছে। তাঁর এই কথায় স্পষ্ট, চীন দেশের ভিতর অত্যন্ত কড়া পদক্ষেপ নিয়েই
সেই কাজটি করার চেষ্টা করেছে। এবং তিনি এও জানান চীনের বাইরে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের
এই ধারা পরবর্তীতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
বিশ্বস্বাস্থ সংস্থার দেওয়া
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই দিন অব্দি ১২৩৯টি সংক্রমণের ঘটনার ভিতর ১৩২ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এবং চীনেই ৯২৩৯ জনের ভিতর সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছিল। আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গল বার ২৮শে
জানুয়ারী সংস্থার অধিকর্তাসহ শীর্ষস্থানীয় নেতৃত চীনের রাষ্ট্র প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ
করে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোনা করেন। এবং করোনা সংক্রমণকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে
আসার বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই বিষয়ে চীন ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তথ্যের আদান
প্রদানের উপর অধিকত জোর দেয়। এই সূত্রে চীন করোনার ভ্যাকসিন তৈরী ও চিকিৎসা পদ্ধতির
উন্নতির বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে সব রকম সহোযোগিতারও আশ্বাস দেয়। তথ্যসূত্র:
রাষ্ট্রপুঞ্জ
৩০শে জানুয়ারী: এইদিন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান করোনা
সংক্রমণকে পাবলিক হেল্থ এমার্জেন্সী অফ ইনটারন্যাশানাল কনসার্ন হিসাবে ঘোষণা করেন।
সংস্থার বৃহস্পতিবারের ঘোষণায়
সকল দেশকে এই বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে সংক্রমণ রুখতে ডাক দেওয়া হয়। জানানো হয় শুধু চীনেই
এইসময়ে ১৭০ জন মারা জান। সংকটজনক রুগীর সংখ্যা চীনেই তখন ১৩৭০ জন। মাত্র ১২৪ জন সুস্থ
হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। এও জানানো হয়, চীনের বাইরে মাত্র ৮২ জনের ভিতর সংক্রমণ
ধরা পড়েছে। এবং তখন অব্দি চীনের বাইরে মোট ১৮টি দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে ছিল। যার ভিতর সাতটি
দেশে সংক্রমণ ঘটে অন্যান্য দেশ থেকে। অর্থাৎ শুধু চীনের উহান বা অন্যান্য শহর থেকেই
নয়, জানুয়ারীর শেষেই বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও নানা দেশেই মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ
শুরু হয়ে যাওয়ার ছবিটা পরিস্কার হয়ে ওঠে। পাঠক এবার ভেবে দেখতে পারেন, জানুয়ারী ৩০শের
এই ঘোষণার পরেও গোটা ফেব্রুয়ারী ও মার্চের ৬০ দিন ব্যাপি আবিশ্ব বিমান পরিসেবা চালিয়ে
যাওয়া হয়েছে স্বাভাবিক ভাবে। আর সেই পথেই আজকে বিশ্ব জুড়ে এই মুহুর্তে সংক্রমিত ১৩
লক্ষ ৫৬ হাজার ২৮২ জন। মারা গিয়েছেন ৭৫ হাজার ৭৫৮ জন। সংকটজনক অবস্থায় ৪৭ হাজার ৫৩৪
জন। ৩০শে জানুয়ারীর ঘোষণার পর থেকে আজ এপ্রিলের সাত তারিখ এই প্রতিবেদন লেখার সময় বিশ্বব্যাপী
সংক্রমণ ৮২ থেকে বেড়ে ১২ লক্ষ ৭৪ হাজার ৫৫২ জন। মাঝের দুই মাস বিশ্বব্যাপী বিমান যাত্রীরা
সংক্রমণ ছড়িয়ে গিয়েছেন অবাধে। বহু দেশই মার্চের শেষ সপ্তাহের আগে অব্দি বিমান পরিসেবা
বন্ধ করে নি।
এইদিনের ঘোষণায় আরও বলা হয়, এই ঘোষণার কারণ চীনে কি
হচ্ছে সেটি নয়, বাকি বিশ্বে পরিস্থিতির কেমন সেটাই। অর্থাৎ জানুয়ারীর শেষই রাষ্ট্রপুঞ্জে
এটা পরিস্কার হয়ে যায়, বাকি বিশ্বে করোনা সংক্রমণ এক ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থার এদিনের ঘোষণায় স্পষ্ট বলা হল, “China quickly
identified the virus and shared its sequence, so that other countries could
diagnose it quickly and protect themselves, which has resulted in rapid
diagnostic tools” চীনের তথ্য গোপন করার
মতো কোন প্রামান্য তথ্য এখনো পাওয়া গেল না। বরং এই সময়ের ভিতর প্রাপ্য সমস্ত তথ্যই
সাম্ভব্য বিশ্ব মহামারী ইংগিত দিয়ে যাচ্ছিল। এরই সাথে জানানো হয়, চীন বাকি বিশ্বের
সাথে সহযোগিতার বিষয় রাজি হয়ে প্রয়োজনে সাহায্যের আশ্বাসও দেয়। আরও বলা হয়, “the
measures China has taken are good not only for that country, but also for the
rest of the world”।
কিন্তু এরপরেই বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থার অধিকর্তা যা বললেন, সেটি যথেষ্ঠ প্রণিধানযোগ্য। তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিলেন,
“….no reason
for measures that unnecessarily interfere with international travel and trade.
We call on all countries to implement decisions that are evidence-based and
consistent. WHO stands ready to provide advice to any country that is
considering what measures to take.”
অর্থাৎ, অবস্থা যেমনই হোক না
কেন, বিশ্বব্যাপী বিমান পরিসেবা ও যাতায়ত বন্ধ করা যাবে না। (ঠিক যে পথটিই করোনা সংক্রমণের
বিশ্ব রাজপথ) আরও বলা হলো, “…evidence has shown that restricting the
movement of people and goods during public health emergencies may be
ineffective and may divert resources from other interventions……..Further, restrictions may interrupt
needed aid and technical support, may disrupt businesses and may have negative
effects” on the economies of those countries affected.” তথ্যসূত্র: রাষ্ট্রপুঞ্জ
এটা ঠিকই যে কোভিড-১৯ এর মতো
সংক্রমণের কোন পূর্ব নজির না থাকা বা এই ধরণের মহামারী মোকাবিলার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা
না থাকাই রাষ্ট্রপুঞ্জের কাল হয়েছে। তারা প্রচলিত ধ্যান ধারণার বাইরে বেড়িয়ে এসে বিষয়টির
সামগ্রিক অভিঘাত বুঝতে সক্ষম হন নি। হলে বুঝতে পারতেন, অন্যান্য বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে
বিমান পরিসেবা সচল রাখার যৌক্তিকতা দিয়ে করোনা মোকাবিলায় বিমান পরিসেবা সচল রাখা সিদ্ধান্ত
নেওয়া মারাত্মক ভুল হচ্ছে। ঠিক একটি মাত্র ভুলের পথ ধরেই করোনা বিশ্বাব্যাপী তাণ্ডবের
ছাড়পত্র পেয়ে গেল। লখীন্দরের বাসর ঘরের ছিদ্রের মতো।
তবুও এরই ভিতর, বিশ্বব্যাপী
করোনা সংক্রমণের গুরুত্ব অনুধাবন করে ৩০শে জানুয়ারীর ঘোষণার গুরুত্ব বোঝাতে আরও স্পষ্ট
করে ২রা ফেব্রুয়ারী জানিয়ে দেওয়া হয়, “A public health
emergency of international concern is declared by the WHO in cases of “an
extraordinary event” which constitutes “a public health risk to other States
through the international spread of disease” and potentially requires a
coordinated international response”. This definition implies a situation that
is “serious, unusual or unexpected; carries implications for public health
beyond the affected State’s national border; and may require immediate
international action”.
তথ্যসূত্র: রাষ্ট্রপুঞ্জ
পাঠক লক্ষ্য করবেন, এরপর ইটালীর
মিলানে ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়ান্স লীগের যে ফুটবল খেলায় ৪০ হাজার দর্শকের জনসমাবেশ থেকে
করোনা সংক্রমণ বস্তুত বিষ্ফোরনের আকার নেয়, সেই খেলাটি ১৯ই ফেব্রুয়ারী সংঘটিত হয়। অর্থাৎ
৩০শে জানুয়ারীর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক চুড়ান্ত সতর্কতার জারির পরেও পরবর্তী
১৯ দিন ইতালী বা অন্যান্য কোন দেশই বিশেষ কোন সতর্কতা অবলম্বন করেছিল না। ফলে করোনা
সংক্রমণ তলায় তলায় সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে বিশ্বময় শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে গিয়েছে।
আর আজ পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যম চীনের তথ্য গোপন করার অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে আবিশ্ব মানুষকে
বিভ্রান্ত করার উদ্দেশে। যার পিছনে ঠিক কোন গুপ্ত পরিকল্পনা রয়েছে, সেটি আজ বোঝা না
গেলেও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে একদিন না একদিন স্পষ্ট হবে নিশ্চয়।
৭ই এপ্রিল’ ২০২০
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত