সেদিনটা ছিল মার্চের বাইশ তারিখ।
আমরা হাসি হাসি মুখে থালা বাজালাম। ঘন্টা নেড়ে হাততালি দিয়ে কোথাও কোথাও মিছিল করে
করোনা তাড়ালাম। তখনও ভারতবাসী হিসাবে আমরা প্রায় কেউই জানতাম না, পেছনের দরজা দিয়ে
মধ্যপ্রদেশের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে নতুন সরকার গঠনের বন্দোবস্তের সমাধান হয়ে
গেলেই দেশব্যাপী লকডাউন জারি হয়ে যাবে। ফলে ২৪শে মার্চ আচমকা দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা।
যে ঘোষণা অনেকের জীবনেই সেদিনের অমাবস্যার অন্ধকার নামিয়ে আনলো। এই অনেকের ভিতর সবচেয়ে
বিপাকে পড়ল দেশব্যাপী পরিযায়ী শ্রমিকের দল। না আমি বা আপনি, কেউই তাদের মোট সংখ্যা
জানি না। সরকার বাহাদুরের এখানেই বাহাদুরি। জনগণকে অন্ধকারে রাখা। যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের
কাছে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ কত বেশি দিনের জন্য কত বেশি নাগরিককে অন্ধকারে রাখা যাবে।
যে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান এই চ্যালেঞ্জটি যত বেশি সাফল্যের সাথে নিতে পারবেন, সেই
সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে ততদিনই নিরঙ্কুশ ক্ষমতাচর্চা সহজ ও শান্তির হবে। ফলে
স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের নাগরিক হিসাবে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার ন্যূনতম কিন্তু
প্রধান একক ভোটার হিসাবে আমরা সত্যই জানি না, এই লকডাউন কত জন পরিযায়ী শ্রমিকের উপর
অমাবস্যার রাত নামিয়ে নিয়ে এসেছে। মার্চের ক্যালেণ্ডারের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাবো,
২৪শে মার্চ ২০২০ সত্যিই পঞ্জিকা মতে অমাবস্যা ছিল। সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের সেন্স
অফ হিউমার সত্যিই অসাধারণ।
আধুনিক সময়ে মিডিয়ার
একটা বড়ো অংশই যদি সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতের পুতুল হয়ে দাঁড়ায়, তবে তো সোনায়
সোহাগা। তাই মার্চের শেষ থেকে প্রায় পাঁচ ছয় সপ্তাহ ব্যাপি লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের
দেশব্যাপি লংমার্চের লাইভ টেলিকাস্ট দেখতে হয় নি আমাদের। আমরা সেই সময় লকডাউনের ছুটি,
চুটিয়ে উপভোগ করতে পেরেছি অনেক নিশ্চিন্তে। দৈনিক সংবাদপত্রে সংবাদ তো অনেকই থাকে।
কিন্তু প্রথম পাতার হেডলাইনে কোন সংবাদ যাবে সেটিই আসল কথা। বৈদ্যুতিন মাধ্যমেও তাই।
ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান সংবাদ চ্যানেলে পরিযায়ী শ্রমিকদের এক্সোডাস নিয়ে কতটুকু চর্চা
হয়েছে, সেটি সকলেই জানেন। আর কোন সম্প্রদায় ভারতে করোনা ছড়িয়েছে, সেই বিষয় নিয়ে কতখানি
চর্চা হয়েছে, সেটাও কারুর অজানা নয়। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো টাইমিং। কখন কোন সংবাদটিকে
তুলে এনে কোন রঙে কিভাবে পরিবেশন করা হবে। যে সময় পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফেরার জন্য উতলা হয়ে
হাজারে হাজারে বাস স্ট্যাণ্ডগুলিতে জমায়েত হয়ে বাসের দেখা না পেয়ে শত শত মাইল হেঁটেই
বাড়ি ফেরার সিদ্ধন্ত নিতে থাকে, এবং শুরু হয় ঠা ঠা রোদের মধ্যে অন্তহীন পথ চলা, ঠিক
সেই সময়েই নিজামুদ্দিন নিয়ে টান দেয় টিভির নিউজ চ্যানেলগুলি। আপনি আমিও বিস্তর নড়ে
চড়ে বসলাম। সত্যিই তো কি সাংঘাতিক কথা! এতো আমাদের জীবন নিয়েই টানাটানি। কি ভয়ঙ্কর
ষড়যন্ত্র! সারা ভারতে এইভাবে করোনা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা? শুরু হয়ে গেল আমাদের মনের
বিষকে জ্বাল দেওয়া। আমরাও অনেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের বিষকে জ্বাল দিয়ে কড়া পাকে
পরিবেশন শুরু করে দিলাম পরিচিত মানুষ জনের ভিতরে। পরিযায়ী শ্রমিকরা তখন হাঁটছে মাইলের
পর মাইল। মায়ের কোলে শিশু। বাবার মাথায় বোঝা। কাঁধে ব্যাগ। টিভির স্ক্রিনে চোখ রেখে,
মোবাইলের হোয়াটসআপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবোধ ছাত্র হয়ে আমরা যখন সাম্প্রদায়িক বিষের জ্বাল
দিচ্ছি। শান দিচ্ছি মনের ভিতরের সুপ্ত জিঘাংসায়।
আমাদের সেই সুপ্ত জিঘাংসায়
আমরা এতটাই উন্মত্ত যে ক্যালেণ্ডারের নির্ঘন্টে আর আমাদের কোন বিশ্বাস নাই। যাবতীয়
বিশ্বাস বিশেষ বিশেষ টিভির এঙ্কারদের কথায়। তাদের বাচন ভঙ্গির নকল করতেই ব্যস্ত তখন
আমরা। তাই খেয়াল করলাম না, ১৩ই মার্চের ঘটনার। ঠিক যেদিন নিজামুদ্দিনে ধর্মীয় সমাবেশ
শুরু হয়, সেদিনই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ঘোষণা করে দেয় করোনা কোন জাতীয় হেল্থ এমার্জেন্সীর
বিষয় নয়। না, সেকথা টিভির দর্শক শ্রোতাকে জানিয়ে দেওয়ার দায় তো নিউজ এঙ্কারদের নয়।
জেনে নেওয়ার দায়ও নয় এক একটি টিভির বাঁধা দর্শকদেরও। তাদের একটিই দায়। টিভির দেওয়া
খবরগুলিকে বেদবাক্য বলে নিজেদের মনের বিষকে লালন পালন করার। ও সময় সুযোগ বুঝে তা ভাইরাসের
মতো ছড়িয়ে দেওয়ার। তাই আমরা দেখলাম না ১৩ই মার্চের স্বরাস্ট্রমন্ত্রকের ঘোষণা। জানলাম
না ৩০শে জানুয়ারীতেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে গ্লোবাল হেল্থ এমার্জেন্সী বলে
বিশ্বের প্রতিটি দেশকে সতর্ক করে দেয়। জানা যায়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ইতিহাসে এই
সর্বোচ্চ সতর্কতা জারির ঘটনা এর আগে মাত্র চার বার ঘটে। যে কোন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের
এই সর্বোচ্চ সতর্কতার গুরুত্ব জানারই কথা। কারণ গোটা দেশের ভালোমন্দের ভার তাদের হাতেই।
আমরা দেখলাম না নিজামুদ্দিনের ধর্মীয় সমাবেশে বিদেশাগত প্রতিনিধিরা ভারত সরকারের মঞ্জুর
করা ভিসাতেই, সরকারী বিমান বন্দর দিয়েই দেশ ঢুকেছেন। তারা যে ভাইরাস নিয়ে ঢুকেছেন,
ভাইরাস সংক্রমিত হয়েই যদি ঢুকে থাকেন তবে তার দায় স্বরাস্ট্রমন্ত্রকেরই। কেন বিমানবন্দরে
তাদের সঠিক ভাবে পরীক্ষা করা হয় নি। ৩০শে জানুয়ারীর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জারি করা
সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা কেন ভারত সরকার গ্রাহ্যের মধ্যে আনে নি। না আমরা যে নির্দিষ্ট
কতগুলি নিউজ চ্যানেলের বাঁধা দর্শক। তাই এইসব সহজ কতগুলি সাধারণ প্রশ্ন আমাদের মাথায়
ঢোকাতে নাই। কারণ ঢোকালে ফেক নিউজগুলিও আর বিশ্বাস করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এবং এর পর পরেই
আমাদের যে ফেক অডিও শোনানো হবে, সেগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের দায়িত্বও যে আমাদেরই
অন্ধ ভক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই আমরা সোজা চোখে না তাকিয়ে বাঁকা চোখেই বানিয়ে তোলা
ছবির উপর আস্থা রাখলাম। আমরা কেউ জানতে চাইলামও না, ১৩ই মার্চে কতজন ভারতবাসী জানতো
২৪শে মার্চ থেকে দেশে লকডাউন শুরু হবে? কিন্তু আমরা ফেক নিউজগুলিতে রীতিমত আস্থা রেখে
জেনে গেলাম লকডাউন অমান্য করেই নাকি নিজামুদ্দিনে ধর্মীয় সমাবেশ করা হয়েছে। ভারতবাসীর
ভিতরে করোনা সংক্রমিত করার যড়যন্ত্রে। আমাদের ভিতরে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এতটাই সংক্রমিত
যে, আমরা এতদিনে জেনে গিয়েছি, কোন কোন তথ্য জানতে নাই। আর কোন কোন খবর জেনে নিতে হয়। এবং জেনে নিয়ে আরও বেশি করে
ছড়িয়ে দিতে হয়। ঘরে ঘরে আমরাও যে এক এক জন বিশেষ বিশেষ নিউজ এঙ্কার!
তাই আমাদেরও আর কোন দায়
থাকলো না প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের চিনে নেওয়ার। আমরা যে আমাদের মনের ভিতর লালন করা ষড়যন্ত্রকারীদের
চেনা ছবিগুলিই পেয়ে গেলাম টিভির পর্দায়। আর তো আমাদের কিছু দরকার নাই। দিনের পর দিন
আমরা লকডাউনে ঘরে বসে বসে বিদ্বেষের ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে থাকলাম দেশব্যাপী। আর ওরা হাঁটতে
থাকলো ওদের মতোই। পায়ের পাতায় হাওয়াই চটির লেসে ঘর্ষণে ছাল চামড়া উঠে ঘা হয়ে গেল। যারা
খালি পায়ে পারি দিল শত শত মাইল, পায়ের তলায় চামড়া ফেটে কুমীরের চামড়ার মতো হয়ে গেল।
বয়স্ক দুর্বল শরীরের পরিযায়ী শ্রমিকরা পথেই মরে পড়ে থাকলো। না এদের কারুর মৃত্যুর হিসাব
রাখার দায় নাই আমাদের। কতজন মারা পড়লো। সরকারও জানতে চাইল না। শুধু ভারতের মানচিত্র
থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেল তারা। বাকিরা হাঁটতে থাকলো। ক্যামেরার লেন্সের বাইরে লক্ষ লক্ষ
ভারতীয়। বিভিন্ন জাতি। বিভিন্ন ভাষা। বিভিন্ন গন্তব্য। কিন্তু পরিচয় একটিই। ওরা কাজ
করে। ওরা খেটে খায়।
আমরা জানি না। কতজন শত
শত মাইল পার করে নিজের বাড়িতে আপনজনেদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। আমরা জানি না আজ তাদের
দিন চলছে কি করে। আমরা জানি না, আজও এই মুহুর্তে এই ভারতের পথ পথে কতজন পারি দিচ্ছে
শত শত মাইল। আমাদের জানার দরকারও নাই কোন। আমরা জেনেছি, নিজামুদ্দিনিরে কথা। আমরা বিশ্বাস
করেছি ফেক অডিওর কথা। আমরা জেনেছি আমাদের একাউন্টে মাস মাহিনার নির্দিষ্ট টাকা ঠিকমতো
ঢুকে গিয়েছে কিনা। শেয়ার মার্কেটে আমাদের লগ্নীর দৈনিক আপডেটের হিসাব। যেগুলি জানা
আমাদের জন্য দরকার। সেগুলিই জানবো আমরা। ঈদ আসছে। আবার আমরা জানবো কিভাবে সেগেন্ড ওয়ভে
অফ ইনফেকশন ছড়িয়ে দেওয়া হবে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায়। আমরা এখন
পোশাক দেখে মানুষ চিনতে শিখে গিয়েছি। তাই রাত নয়টায় নয় মিনিট ধরে আলো নিভিয়ে বাজি ফাটিয়ে
আমরা দেশব্যাপী করোনা মোকাবিলায় সামিল হয়েছি। বাধ্য ছাত্রের মতোন। আমরা আনন্দে মাথা
উঁচু করে আকাশ থেকে কোটি কোটি টাকার পুষ্পবৃষ্টিতে অভিভুত হয়ে শাসক বন্দনায় সামিল হয়েছি।
ঠিক ওরা যখন ট্রেনের অভাবে গাড়ীর অভাবে অশক্ত পায়ে, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে জীবনের শেষ
রক্তবিন্দুকেও বাজি রেখে। নিজের নিজের ভাঙা ঘরের দিকে। পুলিশের লাঠির তাড়া খেয়ে রাজপথ
ছেড়ে ভাঙা আলপথ ধরে। রেললাইনের ওপর দিয়ে। দিনের আলোয়। রাতের অন্ধকারে। পরিশ্রমের ক্লান্তিতে
চোখে অন্ধকার দেখলে, দেখতে পাচ্ছে না মালগাড়ীর চকায় মৃত্যুর ঠিকানা লিখে এগিয়ে আসছে
শেষ সময়। ছিন্নভিন্ন মাংসখণ্ড পোড়া রুটির লাশ পেড়িয়ে বাকিরা এগিয়ে চলেছে আজও। ট্রেন
নাই বাস নাই। লক্ষ লক্ষ পা। লক্ষ লক্ষ পা।
১০ই মে’ ২০২০
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত